গ্রীষ্ম ও বর্ষায় টমেটো চাষ একটি লাভজনক কৃষি।
গুরুত্ব :
টমেটো সাধারণত শীতকালে আবাদ হয়ে থাকে। আমাদের দেশে শীতকালে বেশি পরিমাণে টমেটো আবাদ হয়। অনেক সময় উৎপাদন এত বেশি হয় বাজারে টমেটো সরবরাহ বেশি হয়ে যায় । কৃষক ভালো দাম পায় না ।
অথচ গ্রীষ্মকালে ও বর্ষাকালে আমাদের দেশে সবজির উৎপাদন কম থাকে ফলে বাজারে সবজির দাম বেশি থাকে। তাই বর্ষা এবং গ্রীষ্মকালে যদি টমেটো আবাদ করা যায় বাজারে এর মূল্য ভালো পাওয়া যাবে ।
গ্রীষ্ম ও বর্ষায় টমেটো চাষে সুবিধা কি?
গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে টমেটো চাষে বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা কমবে । বর্তমানে এই মৌসুমে ১৫ হাজার মেট্রিক টন টমেটো উৎপাদন হচ্ছে । আমদানি হচ্ছে প্রায় 20000 মেট্রিক টন। তাই এই দুই মৌসুমে টমেটো চাষ হলে আমদানির নির্ভরতা কমে যাবে। পাশাপাশি কৃষক ভালো দাম পাবে । পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
গ্রীষ্মকালীন ও বর্ষায় চাষাবাদের জন্য কি কি জাত আছে?
বর্তমানে গ্রীষ্মকালীন এই ও বর্ষায় চাষাবাদের জন্য বেশ কিছু টমেটো জাত বের হয়েছে ।
বারি টমেটো ৪ ,বারি টমেটো ৫,বারি টমেটো ৬ ,
বারি টমেটো ১০ ,বারি টমেটো ১৩ ,বারি টমেটো ১৪ ,বারি হাইব্রিড টমেটো ৪ ,বারি হাইব্রিড টমেটো ৮ ,বারি হাইব্রিড টমেটো ১০ , বিনা টমেটো ৩,বিনা টমেটো ৪ গ্রীষ্মকালীন ও বর্ষায় চাষাবাদের উপযোগী।
ইহা ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড জাত সমূহ ।
কোন জাতের বৈশিষ্ট্য কি ?
বারি টমেটো ৪ :
এই জাতটি ফল গোলাকার, প্রতিটা ফলের ওজন ৩৫ থেকে ৪০ গ্রাম ,একটা গাছে ২০ থেকে ২৫ টি ফল ধরে । গাছ প্রতি ফলন ৯০০ থেকে ১০০০ গ্রাম। ৬০ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যে ফল তোলা যায়। গ্রীষ্ম ,বর্ষা মৌসুমে পলিথিন ছাউনিতে চাষ করতে হয় এবং টমেটো টোন হরমোন দিলে ফলন বাড়ে। বর্ষা মৌসুমে হেক্টর প্রতি ফলন ২০ থেকে ২২ টন ।
বারি টমেটো ৫ :
বারি টমেটো ৫ জাতের আকার হৃদপিন্ড আকৃতি, প্রতিটি ফলের ওজন ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম ,গাছ প্রতি ফলন ৮০০ থেকে ১০০০গ্রাম । চারা লাগানোর ৬০ /৬৫ দিনে প্রথম ফল তোলা যায় ।
বারি টমেটো ৬:
বারি টমেটো ৬ এ জাতটি উচ্চ ফলনশীল ,চৈতি নামে পরিচিত। উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। গাছ লম্বা, ফুল ও ফল ধারণ গাছের বৃদ্ধি অবধি অব্যাহত থাকে। ফল গোলাকার ও লাল কালার ।প্রতিটি ফলের ওজন ৮০ থেকে ৯০ গ্রাম। চারা লাগানো ৮০- ৯০ দিনের মধ্যে ফল তোলা শুরু হয় । বর্ষাকালে ফুলে স্প্রে করলে টমেটো বেশি ফলন পাওয়া যায় ।
বারি টমেটো ১০:
যা অনুপমা নামে পরিচিত । গ্রীষ্মকালীন চাষ করা যায় ।এই টমেটোর আকার ডিমাকৃতি। প্রতি গাছে ৭৫ থেকে ৮০ টি ফল ধরে ।একটা ফলের ওজন ২৫- ৩০ গ্রাম ।গাছ প্রতি ফলন দুই থেকে আড়াই কেজি। চারা লাগানো সাত দিনের মধ্যে ফল পাকতে শুরু করে। হেক্টর প্রতিফলন ৪০ থেকে ৫৫ টন ।
বারি হাইব্রিড টমেটো ৩:
হাইব্রিড জাতের মধ্যে এটি গ্রীষ্মকালীন জাত। ফলের ওজন ২৫-৩০ গ্রাম ।গাছ পতি ৩০ -৩৫ টি ফল ধরে। হেক্টর প্রতি ফলন ৩৫-৪০টন। হরমোনের প্রয়োগের প্রয়োজন নাই।
বারি হাইব্রিড টমেটো ৪:
হাইব্রিড জাতের মধ্যে এটি গ্রীষ্মকালীন জাত। ফলের ওজন ৫০ গ্রাম ।গাছ পতি ৩০ টি ফল ধরে। প্রতিফলের গাছ প্রতিফলন দেড় কেজি। হরমোনের প্রয়োগের প্রয়োজন নাই। চারা লাগানো সাতদিন পরেই ফল পেকে যায়।
বারি হাইব্রিড টমেটো ৮:
গ্রীষ্মকালীন জাত, লাল বর্ণের ,বেশ মাঙশল প্রতিটি গাছের ৪০ -৪৫ টি ফল ধরে ।হেকটর প্রতি ফলন ৩৫ থেকে ৪০ টন হতে পারে ।
বারি হাইব্রিড টমেটো ১০ :
উচ্চ ফলনশীল জাত ,ফল মাঝারি আকারের। ওজন ৬৫ গ্রাম, লাল রঙের গোলাকার, প্রতিটা গাছ প্রতি ফলন ১৮ থেকে ২০ টি। ফলন ৪০ থেকে ৪২ টন ।৮০ -৯০ দিনে ফল তোলা যায় ।
জলবায়ু ও মাটি :
উচ্চ তাপমাত্রায় টমেটোর ফুল সাধারণত ঝরে যায় । টমেটোর ভালো ফলনের জন্য ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেন্টি: তাপমাত্রা প্রয়োজন ।টমেটো চাষের জন্য দোআঁশ মাটি উপযোগী।
কেন শীতকালীন টমেটোতে গ্রীষ্মকালীন ও বর্ষায় ফল হয় না?
রাতের তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি সেন্টি:এর উপর থাকায় ফুল ফল হয় না।
টমেটোর বীজ বপনের সময় :
গ্রীষ্মকালীন টমেটোর বীজ বপনের সময় এপ্রিল থেকে জুন মাস ।
জমি কিভাবে তৈরি করবেন ?
টমেটোর ভালো ফলনের জন্য জমি ভালোভাবে চার পাঁচটি চাষ মই দিতে হবে। কম বৃষ্টিপাত হলে পানি সেচ দিতে হবে ।
পলিথিনের ছাউনি কিভাবে দিতে হয়?
ভালো ফলনের জন্য নৌকার আকারের পলিথিনের ছাউনি দিতে হয় ।২৩০ সেন্টিমিটার চওড়া, মাঝখানে ৩০ সেন্টিমিটার নালা লম্বালম্বি ছাউনি ব্যবস্থা করতে হবে। ছাউনির উচ্চতা হবে দুই পাশে ১৩৫ সেন্টিমিটার ,মাঝখানে ১৮০সেনটিমিটার, ৫০ সেন্টিমিটার নালা। পলিথিনের ছাউনির আকার জমির আকারের উপর নির্ভর করবে ।
চারা লাগানোর পূর্বে জমিতে নৌকার সাইজের মতো ছাউনি দিতে হয় ।ছাউনির জন্য বাঁশ খুঁটি দড়ি প্রয়োজনে দুটি ছাউনির মাঝে ৫০ সেন্টিমিটার নালা রাখতে হবে। উচ্চতা ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার হবে । প্রতি ছাউনির ভিতরে দুইটা করে বেড হবে এবং প্রতি বেডে দুইটা করে সারি হবে। ২৫ থেকে ৩০ দিন বয়সের চারা দুই সারিতে রোপন হবে ।গ্রীষ্মকালীন টমেটো গাছে প্রচুর ফুল হয় কিন্তু তাপমাত্রার কারণে পরাগায়ন হয় না ।এক লিটার পানিতে ২০ মিলি টমেটো টমেটো টোন হরমোন মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ।
বীজ শোধন:
টমেটো বীজ কেজি প্রতি দুই গ্রাম ভিটাভেকস দিয়ে শোধন করতে হয় । যাতে রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় ।
চারা উৎপাদন :
সুস্থ সবল চারা উৎপাদনের জন্য পঞ্চাশ গ্রাম পরিপক্ক বীজ তিন মিটার বাই এক মিটার আকারে বীজ তলায় বীজ বুনতে। প্রতি হেক্টরের ২০০ গ্রাম বীজ লাগে এক শতাংশ এক গ্রাম এক একরের জন্য ২২-৩০ তলার প্রয়োজন ।
২য় বীজতলা চারা রোপণ:
৮-১০ দিন বয়সের চারা তুলে দ্বিতীয় বীজতলা রোপণ করতে হবে ৪সেমি*৪সেমি দূরত্বে।
বিঘা প্রতি চারা প্রয়োজন -৪৫০০টি ।
সার প্রয়োগ:
বিঘা পতি স্যারের মাত্রা:
১। গোবর দুই হাজার কেজি-চাষের দিতে হবে।
২। ইউরিয়া মোট ৮০ কেজি- তিনবারে দিতে হবে। ২৭ কেজি+ ২৭ কেজি এবং তৃতীয় কিস্তি ২৭ কেজি।
৩। টিএসপি ৭০ কেজি চাষের শেষ সময় দিতে দিতে হবে ।
৪। পটাশ ৪০ কেজি
জমির চাষের সময় ১০ কেজি ও ১০কেজি দ্বিতীয়+ তৃতীয় বার ইউরিয়া দেওয়ার সময় দিতে হবে।
৫। জিপসাম ১০ কেজি
শেষ চাষের সময় দিতে হবে।
৬। ১ কেজি জিংক সালফেট
এক কেজি চাষের সময় দিতে হবে।
সার কখন দিতে হবে?
শেষ চাষের সময় গোবর +টিএসপি +জিপসাম+ জিংক সালফেট এবং অর্ধেক পটাশ মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
ইউরিয়া ৩ কিস্তিতে চারা রোপণের ১০ দিন ২৫ দিন ৪৯ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে ।
চারার বয়স - ৩০ থেকে ৩৫ দিন ।
কিভাবে চারা লাগাবেন?
১ মিটার চওড়া বেডে ২ সারি চারা লাগাতে হবে। সার থেকে সারের দূরত্ব ৬০ সেন্টিমিটার, গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪০ সেন্টিমিটার।
লাগানোর পর হালকা শেষ দিতে হবে ।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা :
১।সেচ ও নিষ্কাশন:
নালা করতে হবে । চারা রোপনের ৩-৪ দিন পর হালকা শেষ দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে সার প্রয়োগের সময় সেচ দিতে হবে। টমেটো জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারেনা ।
২।নিড়ানী দেওয়া:
সেচের সময় মাটির উপরে চটা ভেঙ্গে দিতে হবে যাতে পর্যাপ্ত বাতাস পায় ।
৩।আগাছা দমন :
ফুল আসার সময় ছাড়া সবগুলি পার্শ্ব কুশি ছাটাই করে দিতে হবে ।
হরমোন ব্যবহার:
বারি হাইব্রিড টমেটো ৩,৪,৮ হরমোন ব্যবহার ছাড়াই ভালো ফলন পাওয়া যায়।তবে হরমোন ব্যবহারে ফলন বৃদ্ধি পায়। বারি টমেটো ৪,৫ হরমোন আবশ্যক। সকাল ৯-১১টায় ফুল অবস্থায় ব্যবহারে ফলন বৃগাপদ্ধি পায়।৭-১০ দিন পর ২য় বার হরমোন ব্যবহার করতে হবে। গাছ প্রতি ৩০-৩৫ টি ফল হলে হরমোন ব্যবহার দরকার নেই।
রোগ বালাই দমন :
১। সাদা মাছি -হলুদ ফাঁদ,নিম জাতীয় কীটনাশক , সহনশীল জাতের চাষ,ম্যালাথিয়ন৫৭ইসি,এভমায়ার। ২০০এস এল।
২।লিফ মাইনার দমন: পাতা কর্তন,রগার স্প্রে।
৩।ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন: ফেরোমিন ফাঁদ
কুশি কর্তন, আক্রান্ত ফল অপসারণ,পারচিঙ,আইল ফসল,trichograma wasp,last of pesticide use in quinalphose group-eg corolux.
রোগ দমন:
১। Damping off -oil cake use in seed bed,Ridomilgold ,
২।ঢলে পড়া-জাত পরিবর্তন,বনজ জাতের সাথে জোরকলম, পানি ব্যবস্থাপনা সতর্ক ভাবে, জমি শোধন,
৩।Late blight-mancojeb use in cloud weather.
সাবধানতা:
১।বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়ুন এবং
নির্দেশাবলি মেনে চলুন।
২।ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন।
৩।ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবেনা।
৪।বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখুন।
৫।বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫দিন পর বাজারজাত করুন।
ফল সংগ্রহ:
ফলের নিচে ফুল ঝরে যাওয়ার পর ওই স্থান থেকে লালচে ভাব শুরু হইলে বাজারজাতকরণের জন্য ফল তুলতে হবে ।
এই ফল সংগ্রহ করলে অনেক দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে।
আগাম ফল তোলা, হরমোন ব্যবহার করে ফল পাকানো ঠিক নয়।
ফলন:
জাতভেদে ফলন ভিন্ন হতে পারে। গড় ফলন ৩০ টন/হেক্টর।
টমেটো চাষে কৃষকরা কত লাভ পেতে পারে?
১ বিঘা টমেটো চাষে খরচ -১২০০০০ টাকা।
১ বিঘা জমিতে টমেটো উৎপাদন -৪০০০কেজি । কেজি প্রতি বিক্রয় ৮০ টাকা হলে মোট বিক্রয় মূল্য -৩২০০০০টাকা।
লাভ-২০০০০০টাকা।
0 Comments