বাংলাদেশে সরিষার তেল বাড়ানোর উপায়
‘স্বল্প মেয়াদের আমন ধান আর বােরো মাঝে
উচ্চফলনশীল সরিষা করাে,
তেলের অভাব ফুরিয়ে যাবে
গােলাভরা ধানও পাবে।'
তেল উৎপাদনের পরিকল্পনা:
আগামী
তিন বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদার চল্লিশ ভাগ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করতে হবে। ধানের
উৎপাদন না কমিয়ে মাঝারি উঁচু বা উচু জমিতে উচ্চফলনশীল এবং স্বল্পমেয়াদি আমন ও
বােরাে ধানের মধ্যবর্তী সময়ে খুব সহজেই সরিষা চাষ করে প্রয়ােজনীয় ভােজ্যতেলের
চাহিদা মেটানাে যায়। এজন্য দরকার সঠিক সময়ে সঠিক জাতের আমন, সরিষা ও বােরাে ধানের চাষাবাদ।
কিভাবে তেল ফসলের চাষ বাড়বে:
১।আমন ধানের জাত ও রােপণের সময়ের পরিবর্তনের মাধ্যমে:
অধিক ফলনশীল জীবনকাল সম্পন্ন জাতসমূহ :
ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৮৭, ব্রি | ধান৯৫, বিনাধান-১৬, বিনাধান-১৭, বিনাধান-২২
রোপণের সময়:
জুলাই শুরুতে আমন ধানের বীজতলা করতে হবে। চারার বয়স ২৫ দিন হইলে জমিতে রোপন করতে হবে । তাহলে ধান সময় মত কাটা যাবে এবং সরিষা বীজ বপনের যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। চারার বয়স কম হয় এমন ধানের ফলনও বেশি পাওয়া যাবে
বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের জেলাগুলাতে এই সময়ের ১০ থেকে ১৫ দিন আগে আমন ধানের বীজতলা তৈরি করতে হবে এবং চারি রোপণ করতে হবে ।বেশি বিলম্বে করলে ধান চিটা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সরিষার জাত ও বপন সময়:
সল্প জীবনকাল সম্পন্ন সরিষার জাতসমূহ:
বিনা সরিষা-৪,বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা-১০, বিনা সরিষা-১১,
বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৮।
সরিষার বীজ বপনের সময় সময় :
কার্তিক মাসের মধ্যে সরিষার বীজ বপন করা সবচেয়ে ভালো। বেশি ফলন পাওয়া যাবে। তবে যে ক্ষেত্রে ধান কাটতে কিছুটা দেরি হবে সেখানে কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহে সরিষা বীজ বপন করা যাইতে পারে।
২। বােরাে ধানের জাত ও রােপণের সময় পরিবর্তন করে:
বোরো ধান হতে হবে অধিকরণশীল, স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন ।
এই ধরনের জাত সমূহ
ব্রিধান৮৮, ব্রি ধান৮৯, ব্রিধান৯২,ব্রিধান৮১, বঙ্গবন্ধু ধান১০০, বিনাধান-১০, বিনাধান-২৪, বিনাধান-২৫
বোরো ধানের বীজ বপন ও রোপনের সময়:
ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে বোরো ধানের বীজতলা তৈরি করতে হবে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ধানের চারা রোপন করতে হবে । চারার বয়স ৩৫ থেকে ৪০ জনের মধ্যে রাখতে হবে ।বোলান চারা ব্যবহার করা হলে ৪০ দিনের মধ্যেই করতে হবে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা গুলোতে ১০ থেকে ১৫ দিন আগে বীজ তলায় বীজ বপন করতে হবে ।এরপরে চারা রোপন করতে হবে। তা না হলে হওয়াটা আশঙ্কা থাকে। চারার বয়স ৩৫ থেকে ৪০ দিন হতে হবে।
কোন জাতের সরিষায় কতটুকু তেল পাওয়া যায়?
বারি সরিষা ১৪: ৪৩ থেকে ৪৪ পার্সেন্ট
বারি সরিষা ১৮ :৪০- ৪২ পার্সেন্ট
বিনা সরিষা ৪: ৪৪ পার্সেন্ট
বিনা সরিষা ৯:৪৩ পার্সেন্ট
বিনা সরিষা ১১: ৪৪% ,,।
কোন কোন সার ব্যবহার করলে সরিষার তেলে গুণগত মান বেড়ে যায়?
জিপসাম ও বরিক এসিড ব্যবহার করলে তেলের তেলের পরিমাণও বাড়ে এবং গুণগত মানও ভালো হয়।
সরিষার সাথে মৌচাষ কেন করা হয়?
সরিষার সাথে মৌমাছি চাষ করলে পরাগায়ন বেড়ে যায় ।ফলে সরিষার ফলনও বেড়ে যায়। সাথে মধু পাওয়া যায় ,যাহা একটি বাড়তি লাভ । অতএব সরিষার সাথে মৌচাষ করলে ফলন বাড়ার সাথে সাথে মধুর বাড়তি আয় হয়ে থাকে।
সরিষা ফসলের ফলন বাড়ানোর সাথে কতবার সেচ দেওয়া উচিত?
সরিষার ভালো ফলন পেতে হলে বীজ বপণের ১৫-২০ দিনের মাথায় একবার এবং ফুল আসার আগে একবার এই দুইবার সেচ দিলে সরিষার ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশে তেল ফসল আবাদে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলি কি কি?
১। বাংলাদেশে দুই ফসলি জমি রয়েছে প্রায় ২০% এই জমিগুলোতে দুই ফসলের মাঝখানে সরিষা ফসলাবাদের সুযোগ রয়েছে এছাড়া যে সকল জমিতে শুধুমাত্র আমনধানের আবাদ হয়ে থাকে সেখানে আগাম ফসল হিসেবে সরিষা আবাদ করে যেতে পারে
২। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে বরিশাল বিভাগের জেলাগুলাতে আমন ধান কাটতে অনেক সময় দেরিতে কাটা হয় ফলে সরিষা আবার কিছুতে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে সেই ক্ষেত্রে অনেক সময় রিলে ফসল হিসাবে সরিষা আবাদ করা যাইতে পারে ।
৩। সমুদ্র উপকূলীয় জেলাগুলাতে বর্তমানে সূর্যমুখী চাষের একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । এখানে আমন ধান কাটতে কাটতে জানুয়ারির মাঝামাঝি হয়ে যায় সেই সময়ে সরিষা আমাদের সেই সময়ে সে সময়ে সরিষা আবাদের সময় থাকে না তাই কৃষকরা সূর্যমুখী আবাদ করে থাকেন ।
বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী বরগুনা ভোলা পিরোজপুর ঝালকাঠি এবং বরিশাল জেলায় কৃষকরা যে সকল জমিতে বর্তমানে সূর্যমুখীর আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । কৃষকরা বাজার মূল্য ভালো পাচ্ছে সূর্যমুখী তেল নিজেরাও ব্যবহার করতেছে ।এই এলাকায় সূর্যমুখীর একটা বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে ।তাই বাংলাদেশের এই লবণাক্ত জেলাগুলিতে সরিষার চাইতে সূর্যমুখী দেওয়া উচিত।
৩। বাংলাদেশের প্রায় ১০ থেকে ১২% এলাকা চর বেষ্টিত। এই চর এলাকাগুলোতে তিল ফসলের আমাদের একটা বিশাল সুযোগ রয়েছে। সরিষার পাশাপাশি তিল ফসল আবাদের জন্য বিবেচনায় আনা উচিত ।তেলের ঘাটতি মোকাবেলায় যে এলাকায় যে ফসলের উপযোগিতা রয়েছে সেখানে সেই ফসল
চাষাবাদের পরিকল্পনা করা উচিত।
৪। বাংলাদেশের ভোলা একটি দ্বীপ জেলা । বর্তমানে এই জেলাতে কৃষকরা সয়াবিন চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। এছাড়াও বরিশালের হিজলা সহ বেশ কয়েকটি চড় উপজেলা ছয় ফিঞ্চ চাষের প্রতি আগ্রহ বেশি হচ্ছে ।কারণ সয়াবিন চাষে কৃষকরা ভালো বাজার মূল্য পায় ।সয়াবিনের তেল নিষ্কাশনের মেশিন বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশে তেল উৎপাদনে এই দক্ষিণাঞ্চলে জেলাগুলা বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।
৫। তেল ফসল বাড়ানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হল মৌসুমী প্রতি জমি কে সরিষা চাষের আওতায় আনা । বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগের অনেক জেলাতেই রবি মৌসুমে বেশ জমি অনাবাদি থাকে। এইসব জমিতে সুবিধা জনক থাকলে সরিষা অথবা সূর্যমুখী আবাদ করা যেতে পারে ।
সূর্যমুখীর ভালো জাত কি ?
হাই সান ৩৩ ও বারি সূর্যমুখী ২
বাংলাদেশের তেলের চাহিদা কত?
বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন । আমাদের দেশে উৎপাদন হয় তিন লাখ মেট্রিক টন ।২১ লাখ মেট্রিক টন তেল আমদানি করা লাগে।
তেল ফসল দ্রুত বাড়ানোর জন্য কি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে? নিলে সরিষার আবার বা তেল ফসলের অভাব দ্রুত বৃদ্ধি পাবে?
কৃষকদেরকে প্রণোদনা দিয়ে বিনামূল্যে বিশ্ব সরবরাহ করে প্রদর্শনী সরবরাহ করে এমনকি বিভিন্ন ফসলের বিশেষ করে তেল ফসলের উৎপাদন খরচ পোষায়ে নেওয়ার জন্য কৃষকদের কে সহজে কৃষি ঋণ দেওয়া যেতে পারে ।এছাড়া কৃষকদেরকে খরচের উপকরণ হিসেবে সার ও কীটনাশক সরবরাহ দেওয়া যেতে পারে।
সূর্যমুখীর বীজ কোথায় পাওয়া যাবে?
হাইসান ৩৩ ব্রাক সরবরাহ করে থাকে এছাড়া বারি সূর্যমুখী ২ ও ৩ কৃষি গবেষণা সরবরাহ করে থাকে এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির কাছে সূর্যমুখী বীজ পাওয়া যাবে ।
কোন জাতের সরিষা ভালো?
বারি সরিষা ১৪,১৫ বিনা সরিষা ৪,৯,১১ ভালো।
জমির পরিমাণ না বাড়িয়ে কিভাবে সরিষার উৎপাদন বাড়ানো যায়
১।যে সকল জমিতে আখ চাষ করা হয় আখের আন্তঃ ফসল হিসেবে সরিষা চাষ বাড়ানো যাইতে পারে ।
২।যে সকল জমিতে রবি মৌসুমে ভুট্টা চাষ করা হয় ভুট্টার সাথী ফসল হিসেবে দুই সারির মাঝখানে সরিষা ফসল করা যাইতে পারে ।
৩।যে সকল জমিতে কলা চাষ করা হয়, রবি মৌসুমে কলার আন্ত ফসল হিসেবে সরিষা চাষ করা যেতে পারে।
৪।যে সকল জমিতে খেসারি ও মসুর চাষ হয় এদের সাথী ফসল হিসেবে সরিষা চাষ করা যেতে পারে ।
৫।যেসব জমিতে আলু চাষ হয় আলুর আইল ফসল হিসেবে চারি পাশে সরিষা চাষ করা যাইতে পারে ।এতে করে আলুর জাব পোকা দমন সহজ হবে এবং সরিষাও পাওয়া যাবে ।
৬। স্থায়ী ফল বাগানে সরিষা চাষ করা যাইতে পারে ।বাংলাদেশে বহু আম ,পেয়ারা, পেঁপে, লিচু ও মাল্টার বাগান রয়েছে ।এইসব বাগানে আন্ত ফসল হিসেবে সরিষা চাষ করা যেতে পারে ।
৭।বড় রাস্তার দুই পাশে বাধের ঢালে এবং উঁচু আইলে সবজি চাষের পাশাপাশি সরিষা চাষ করা যাইতে পারে।
৮। সরিষার ভার্টিকেল উৎপাদন বাড়ানোর আরেকটি উপায় হল স্থানীয় জাতের পরিবর্তে উফসী জাতের সরিষা চাষ করা ।এতে করে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
0 Comments